ভারতের চেয়ে যেখানে এগিয়ে বাংলাদেশ !!



বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আকারে যেমন বিস্তর ফারাক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ব্যবধান তার চেয়েও হয়তো বেশি। পারমাণবিক শক্তিধর বিশাল এই প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলেছে। অনেক সময় অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত সমস্যা,
সমুদ্রসীমা, বাণিজ্যঘাটতি ইত্যাদি ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। তার পরও স্বাধীন বাংলাদেশ নীরবে পথ চলে অনেক বিষয়ে ভারতের কাছে ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচক বলছে, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ভারতের চেয়ে।
সম্প্রতি ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী জ্যঁ দ্রজের লেখা ‘অ্যান আনসার্টন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস’ বইয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেকগুলো দেশের সঙ্গে ভারতের উন্নয়ন সূচকের তুলনা করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে গড় আয়ু, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন, শিক্ষাসুবিধা, নারীশিক্ষা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে।
অমর্ত্য সেনরা লিখেছেন, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ৬৪ বছরে ভারত জিডিপি, মাথাপিছু আয়, আয়ুষ্কাল, নারীশিক্ষা, শিশুমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এ সাফল্য ম্লান হয়ে যায়। এসব সূচকে উপমহাদেশের সন্ত্রাসাক্রান্ত পাকিস্তান ছাড়া আর সব দেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো।
অমর্ত্য সেন ও জ্যঁ দ্রজ তাঁদের বইয়ে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, ২০১১ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় তিন হাজার ২০৩ ডলার ও বাংলাদেশের এক হাজার ৫৬৯ ডলার। অথচ বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ৬৯ বছর হলেও ভারতীয়দের গড় আয়ু ৬৫ বছর।
শিশুমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যুর গড় ৩৭; আর ভারতে সেই সংখ্যা ৪৭। বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কারণে জন্মহারও কমিয়ে আনতে সফল হয়েছে বাংলাদেশ। এ সূচকে বাংলাদেশের জন্মহার ২ দশমিক ২। ভারতের ক্ষেত্রে তা ২ দশমিক ৬।
বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ব্যবহার করে, অথচ ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে মাত্র ৩৪ শতাংশ মানুষ স্যানিটেশনের আওতায় আছে।
নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ভারতের চেয়ে কিছু বেশি। আপাতভাবে মনে হয়, ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক প্রগতিশীল এবং দেশটিতে নারীদের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। কিন্তু তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশ নারী শিক্ষার সুযোগ পায়। ভারতে সেই সংখ্যা ৭৪ শতাংশ।
শিশুদের সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষায় ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগ ও সাফল্য অনেক বেশি। বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ শিশু সংক্রামক ব্যাধির চিকিত্সার আওয়ায় এলেও ভারতের মাত্র ৭২ শতাংশ শিশু এ সেবা পাচ্ছে।
অমর্ত্য সেন ও জ্যঁ দ্রজ তাঁদের বইয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তুলনা হতে পারে একটি কাজের কাজ। গত প্রায় ২০ বছরে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ হয়েছে অনেক বেশি। ১৯৯০ সালে ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় ছিল বাংলাদেশের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। ২০১১ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তার পরও এ সময়ে বেশ কিছু সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।...সামাজিক উন্নয়ন সূচক দেখে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো বলে মনে হয়, যদিও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের অর্ধেকের কম।’
অমর্ত্য সেন ও জ্যঁ দ্রজ মনে করছেন, ভারতের যে অর্থনীতিকে নিয়ে এত গর্ব করা হয়, তা দেশটির মানুষের জীবনমানের সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। হার্ভার্ডের এই সাবেক অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ভারতের গণতন্ত্রের ব্যবস্থাপনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনিয়মের ভূত। তাঁদের মতে, ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্জনগুলো জনগণের জীবনমান ও স্বাধীনতা জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনছে, তার সাপেক্ষে এ উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে বিচার করতে হবে।’ অমর্ত্য সেন তো মনেই করেন: উন্নয়ন হলো জনগণের স্বাধীনতার সমান, যা আবার সামাজিক বিচারের সমপরিমাণ।
এই অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরাট অর্জন বলে গণমাধ্যমে ‘ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের’ যে ঢাক পেটানো হয়, তা পক্ষপাতহীন নয়, বরং অনেকখানি সন্দেহজনক। ভারতীয় গণমাধ্যমে সে দেশের সাফল্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হামেশাই চীনের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়। এতেও ফাঁকি আছে বলে ধারণা করছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
‘ইন্ডিয়া টুডে’ সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাও সে তুংয়ের চীন কমিউনিজমকে ছুড়ে ফেলে সামাজিক পুঁজিবাদকে আঁকড়ে ধরেছিল দেং জিয়াওপিংয়ের আমলে। স্বাধীনতার ৬০ বছরের বেশি পেরিয়ে ভারত বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল গণতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর পরও ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ চীনের মতো আশা জাগানিয়া নয়। সামাজিক পুঁজিবাদী চীন কেবল তার নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নই ঘটায়নি, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়েছে বিপুল পরিমাণে।
তবে কী ভারতের পিছিয়ে থাকার কারণ এর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা? অমর্ত্য সেন ও জ্যঁ দ্রজ মনে করছেন, ভারতের গণতন্ত্র নয়, বরং এর রাজনীতি, পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থার ব্যর্থতাই পশ্চাত্পদতার মূল কারণ।
এই দুই অর্থনীতিবিদ আক্রমণ শাণিয়েছেন মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা ও সমর্থকদের প্রতি। মুক্তবাজারিদের মত হলো, বিশ্বায়ন হলে অর্থাত্ পুঁজির আধিপত্য বাড়লে গরিব মানুষ এমনিতেই কিছু কিছু সুবিধা পাবে। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের জীবনমানের উন্নতি হবে। তাঁদের ‘অ্যান আনসার্টন গ্লোরি’ বইয়ে এ মতকে ‘ছলনা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বইয়ের ভাষ্য হলো, চুইয়ে পড়া সুবিধার তত্ত্ব হলো ধনী ও অভিজাতদের সৃষ্ট কল্পকাহিনি। এ ধনীরা কেবল বিভিন্ন উন্নয়নের সুবিধাভোগীই নয়, বরং বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের সুফলভোগীও।
‘ইন্ডিয়া টুডে’ সাময়িকী বলছে, বইটিতে অমর্ত্য সেন ও জ্যঁ দ্রজের মত প্রকাশের ধরনকে বামপন্থী বলে মনে হয়। কিন্তু ভারতের ঝিমিয়ে যাওয়া অর্থনীতি ও উন্নয়নের সঠিক দিশা দিতে এটুকু যাতনা সহ্য করতেই হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন